Wednesday, June 10, 2020

ওড়না (গল্প ও ঘটনা)

ওড়না
শ্রীজা ঘোষ সুর



তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ওলি। শ্বশুরবাড়ির লোকের  কথাগুলো যেন শেল হয়ে বিঁধছে মনে। অনীককে বার বার একই কথা বলতে গেলে এবার সেও বিরক্ত হবে। কিন্তু এতে তার কি দোষ? এরকম অসভ্যের মতো কথা শুনলে কেই বা ঠিক থাকতে  পারে?
মাত্র তিন মাস হয়েছে বিয়ে হয়েছে অলির। বাবা মা, দাদা যথাসাধ্য দিয়েছে। গয়না, বাসন, বাহারি নমস্কারি, ঠাসা তত্ত্ব এছাড়াও আরো যা যা দেওয়া যায়। সাধ্য মতো সব দেওয়া হয়েছে অলির বাড়ি থেকে। না অনীকের বাবা মা কিচ্ছুটি চাননি। মানে এখনের যেটা হাল ফ্যাশান। আপনি আপনার মেয়েকে দেবেন। আমাদের ছেলের আর কি দরকার? সবই আছে তো। কিন্তু যত দিন যায় এই ফ্যাশানের খোলসটা রয়ে যায়। ভেতরটা বেরিয়ে পড়ে। অলির ক্ষেত্রও হলো ঠিক তাই। অষ্টমঙ্গলার পর থেকেই শুরু হলো চিরাচরিত বউ ও বউয়ের বাপের বাড়ির খুঁত ধরার কাজ। এ যেনো এক অঘোষিত নিয়ম। তুমি জখন এসেই পড়েছ তখন বলি কাঠে গর্দান তো তোমাকে দিতেই হবে। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই ওলির শাশুড়ি ও শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন সেই চিরাচরিত ধর্ম পালন শুরু করলো। অলির শাশুড়ির পছন্দ হয়নি বাপের বাড়ি থেকে আনা কোনো কিছুই। উঠতে বসতে বলেন, তোমার বাপেরবাড়ি থেকে অনিকে যে আংটিটা দেওয়া হয়েছে সেটা যেন বড্ড হালকা। তা দিলেন যখন মন খুলেই দিতে পারতেন। 
কখনো বা বলে বসেন “তা বৌমা তোমার দাদা তো বড় চাকরি করে তা আলমারিটা অমন ছোট কোনো? লজ্জায় তো সকলের সামনে মাথা হেট করে দিলে।“ আজ শাশুড়ির ছোটভাজ তনু এসেছেন। বিয়েতে আসতে পারেননি তাই আজ এসেছেন নতুন বউয়ের মুখ দেখতে। নমস্কারিতে আনা দামি জামদানিটা দিয়েই ওলির সামনেই শাশুড়ি মুখ চোখ ঘুরিয়ে শুরু করলেন  “ নাও তনু ধরো। কি আর বলবো। নমস্কারি দিয়েছে দেখো। মানুষকে কি দিতে হয়, আর না হয় জানেনা বোধহয়।“ 
ওলি আর চোখে জল ধরে রাখতে পারেনি। ছুটে বেরিয়ে গেছে পেছনের বাগানে। তখন সন্ধে সাতটা। বেশ অন্ধকার। হঠাৎ যেন কে ওড়না ধরে টানলো। অনি কি তাহলে অফিস থেকে ফিরে এলো। পেছন ফিরে অনিকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে যাবে ওলি, কিন্তু কই কোথাও তো কেউ নেই। এবার জোরে ওড়না সমেত চাপ পড়লো গলায়। উফফ আর তো ছাড়ছে না। কোনো রকমে পেছনে ফিরলো। একি ! এ কাকে দেখছে !! আলো ছায়ায় স্মৃতিপর্ণার অবয়ব মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ। একদম ঠিক। চিনতে একটুও ভুল হচ্ছে না। আজকের দিনেই তো।
 স্মৃতিপর্ণা মানে ওলির বৌদি। আজকের দিনেই দু বছর আগে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তখন মাত্র এক বছর বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল তার দাদা বৌদির। তখন তার বৌদি সন্তানসম্ভবাও ছিল।
কিরে ওলি? আমি এসেছিরে। সংসার কেমন করছিস জানতে খুব ইচ্ছে করছে। হিসহিস করে বলে উঠলো স্মৃতিপর্ণা। কথা বলতে পারছেনা ওলি। ওড়নার ফাঁসটা যেন ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে। 
মনে আছে ওলি আমি কেমন চোখে সাজানো স্বপ্ন নিয়ে দাদার হাত ধরে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সবই ঠিক ছিল।  কিন্তু কি জানিস তো মায়ের ওই কথাগুলো না রোজ আমাকে বড়ই কষ্ট দিতো। মা, বাবা, শিক্ষা নিয়ে সবসময় কথা বললে বড্ড আঘাত পেতাম। তুইও যে বড্ড উস্কাতিস মাকে। তোর দাদা মায়ের মুখের ওপর কিছু বলবেনা বা তোকে চটাবেনা তা তো জানতাম। তাই বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। পুজোর তত্ত্ব এসেছিল আমার বাপের বাড়ি থেকে। তুই অমনি একের পর এক খুঁত বার করতে শুরু করলি। বললি সালোয়ারের সঙ্গে যে ওড়নাটা দেওয়া হয়েছে সেটা নাকি ছেঁড়া। আমি দেখেছিলাম ওড়নাটা তুই ছিঁড়েছিলিস। উস্কে দিয়ে মজা দেখতে চেয়েছিলিস। মা আমাকে এক ঘর লোকের সামনে কি অপমানটাই না করলো।  আর সহ্য করতে পারিনি রে। সেদিন রাতেই গলায় ফাঁস লাগালাম। বিশ্বাস কর খুব কষ্ট হয়েছিল। আরো কষ্ট হয়েছিল নিজের সন্তানকে মেরে ফেলছিলাম বলে।
হঠাৎই যেন আকাশ চূর্ণ করে স্মৃতিপর্ণার কান্নার শব্দ পাচ্ছে ওলি। তার সঙ্গে সঙ্গে ওড়নার প্যাঁচটাও যেন আরো শক্ত হতে থাকছে গলায়। 



No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment. Feel free to contact for any queries, suggestions or any proposal.