Wednesday, December 21, 2022

কাগজের তন্তু দিয়ে দুর্গা প্রতিমার সৃষ্টি; প্যাশনকে পেশায় রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখেন তনিশা

কাগজের তন্তু দিয়ে তৈরি দূর্গা 


সুদীপ পাকড়াশী

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই তার সৃষ্টি করার ঝোঁক। তখন তিনি এলাহাবাদের বাসিন্দা। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি থেকেছেন এলাহাবাদে। স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের উদ্যোগে হওয়া দুর্গা পুজোর আগে থেকে প্যান্ডেল প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে তার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। প্যান্ডেলের ডিজাইনিং-এর অনেকটা কাজই তিনি করে দিতেন। সেখানেও সৃষ্টির উপাদান খবরের কাগজের তন্তু। তার সঙ্গে থাকত শোলার কাজ। প্রশংসা তখন থেকেই তিনি পেয়েছেন তার সৃষ্টির বিনিময়ে। এমনকী, দেরাদুনে এক বছর হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করার করার সময় 


সেই তনিশা দাস এখন থাকেন কলকাতার বেহালায়। দু'বছর এসেছেন। তার বয়স এখন ২১ বছর। কলকাতারই এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি বিবিএ পড়ছেন। প্রতিভার যথাযোগ্য বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভালবাসা। সেই ভালবাসাতেই তনিশার শিল্প সৃষ্টি চলছে। কাগজের তন্তু দিয়ে তৈরি করছেন ঠাকুর। দুর্গা এবং তার সহচরীদের সকলেই কাগজের। এমনকী, তনিশার অসুরও কাগজের তন্তু দিয়ে তৈরি হয়। প্রায় চার কিলো কাগজ তার প্রয়োজন হয় এই যজ্ঞে। কাঠামোটি তিনি কুমারটুলি থেকে নিয়ে আসেন। তার ওপর তৈরি হয় তনিশার মূর্তি। সেখানে কাগজের তন্তুর সঙ্গে আবরণ হিসেবে থাকে কাপড়ের সুক্ষ ফালির আস্তরণ। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় রঙ, কিছু কেমিক্যালের ব্যবহার। সহজ নয় এই কাজ। তিন মাসের বেশি সময় ধরে প্রত্যেকদিনের নিবিড় পরিশ্রমে তৈরি হয় এই সৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে তনিশা বললেন, "পড়াশুনো আর বাড়ির অন্যান্য কাজ সামলে আমি প্রত্যেকদিন তিন ঘণ্টা করে ঠাকুর তৈরির কাজ করেছি।"

আজ ২০২২- তনিশার কাছে এই শিল্প সৃষ্টির উৎস কিন্তু তার প্যাশন নয়। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও! নেপথ্যে রয়েছে জীবনের এক দূর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। গতবছর তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দিদির পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া। যার প্রতিফলন, তনিশার চূড়ান্ত অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া। কর্মসূত্রে বাবা নাইজেরিয়ায় থাকেন। মা-কে- মাঝেমাঝে জেতে হয় সেখানে। অন্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকা তনিশার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার লড়াইটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শিল্পসৃষ্টির মতই তনিশার আর একটি ভালবাসা ছিল ডাক্তারি পড়া। পড়ছিলেনও সুদূর জর্জিয়ায় একটি কলেজে। কোভিডের জন্য ফিরে এলেন কলকাতায়। বিশ্ব কোভিড-মুক্ত হওয়ার পর জর্জিয়ার সেই কলেজ থেকে তাকে ডেকেছিল। কিন্তু ততদিনে যে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে তনিশার! কোভিডই কেড়ে নিয়েছে তার দিদিকে। মেডিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়াও বন্ধ হয়ে গেল। তনিশা কিছুই ভোলেননি। বলছেন, "কারুর সঙ্গে কথা বলতাম না সারাদিন। খাওয়াও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে চলে গিয়েছিলাম। সেই অবস্থা থেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াইয়ে প্রধান সহায় হল ঠাকুর তৈরি। এখানে বাড়ির ছাদে দুর্গা পুজা হত। আমার মনে হল মাটির ঠাকুরের বদলে আমি কাগজের ঠাকুর তৈরি করতে পারি। বাবা-মা আর অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরাও সমর্থন করল। তাতে গতবছর প্রথমবার আমাদের বাড়ির ছাদে বসেছিল আমার ঠাকুর। ঠাকুরই আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল স্বাভাবিক জীবনে।

এখন তনিশার মনে হয় তার শিল্প সৃষ্টির ভালবাসাকে যদি ভবিষ্যতে পেশায় রূপান্তরিত করা যায়। তনিশার কথায়, "ফ্যাশন ডিজাইনিং নয়, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট নিয়ে যদি কোনও ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনো করা যায় তার খোঁজে রয়েছি। আমি চাই আমার কাগজের ঠাকুরগুলো মানুষ দেখুক। যদি এরকম কোনও প্রদর্শনীর আয়োজন করা যায়। এখনই আমি রোজগারের কথা ভাবছি না। শুধু সাধারণ মানুষকে জানাতে চাই যে আমি এই কাজটা করি।"

আর হ্যাঁ, তনিশার কাগজের দুর্গা প্রতিমার ভাসান হয় না! সেই প্রতিমার মধ্যে দিয়েই সবচেয়ে প্রিয় দিদি বেঁচে আছেন তনিশার সঙ্গে!

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment. Feel free to contact for any queries, suggestions or any proposal.