সুদীপ পাকড়াশী
ডোকরা শিল্প ভারতের প্রাগৈতিহাসিক কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে একটি। যার বয়স প্রায় চার হাজার! প্রত্নতত্ববিদরা এই শিল্পের নিদর্শন প্রথম দেখেছিওলেন হরপ্পা আর মহেঞ্জোদরো খুঁড়ে বার করার সময়! কয়েক হাজার বছর আগে এক বিশেষ ধরণের 'মেটাল কাস্টিং' পদ্ধতির প্রয়োগে সৃষ্টি করা হত নানা রকমের শৈল্পিক উপাদান। পদ্ধতিটির একটি নামও রয়েছে, 'লস্ট ওয়াক্স কাস্টিং'। ধাতুর পটের ওপর রাধা-কৃষ্ণের ছবি থেকে শুরু করে ধাতুর তৈরি গনেশ, কৃষ্ণের মূর্তি, ধাতুর তৈরি পটের ওপর লক্ষী ও তার কাহিনীর চিত্রায়ণ-সমস্ত কিছুর সৃষ্টি হয় এই শিল্পে। পরবর্তীকালে মধ্যপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ড হয়ে ধোকরা শিল্পের চর্চার প্রতিষ্ঠা হয় বাঁকুড়া, বীরভূম ও বর্ধমানে।
৫৩-বছর বয়সী গীতা কর্মকার জানেন এই ইতিহাসের কথা। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ডোকরা শিল্পী এই মহিলা। বাঁকুড়ার বিঘনা, শিল্পগ্রামে ডোকরা শিল্পের সাধনা তিনি করে চলেছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে! ২০০৩-এ রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারও পেয়েছেন। কিন্তু কোথায় সেই পুরষ্কারের অহং! গীতা দেবীকে মনে না পড়ালে হয়ত তিনি নিজে থেকে বলতেনও না! তার স্মৃতিতে যে এখনও উজ্জ্বল শৈশবের অপরিসীম লড়াইয়ের দিনগুলো। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই। বাবা বিড়ি বাঁধতেন। চার বোন আর এক ভাই। অল্পবয়সে পিতৃহীন হতে হল। ভাই আর বোনদের ভাত যোগাতে হবে যে! মা-র সঙ্গে লোকের বাড়ি কাজ করতেন। তার সঙ্গে অন্যের জমিতে চাষের কাজ, মানে দিনমজুর হয়ে খাটা। তারই মধ্যেও হাতের কাজের শখ ছিল। কাপড়ের টুপি, বালিশের ঢাকা, মাফলার তৈরির কাজও চলত। সেগুলো বিক্রি করে কতই বা রোজগার ছিল।কত দিন যে ভাল করে খাওয়া জোটেনি!
সেই গীতা কর্মকারের এক বিকেলে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল! পণ দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই সকালে মেয়ে দেখতে এসে বিকেলে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামীর নাম গোপাল কর্মকার। তার হাতেই ধোকরার হাতে খড়ি। প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। গীতা বলছিলেন, "প্রথমে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘরের এত কাজ করতে হত যে ধোকরা শেখা হয়নি। তারপর মেয়ে হওয়ার আগে আমি স্বামীর কাছে শিখেছিলাম ধোকরার কাজ। সকাল থেকে বসতাম। তখন শুধু শিল্প গড়া আর ভাঙার কাজ ছিল। কতক্ষণ যে কাজ করতাম মনে নেই। বিকেল হয়ে যেত দুপুরের খাওয়া শেষ করত।"
গীতা দেবীর ডোকরার কাজ প্রথম দেখেছিল দিল্লির হাট, কলকাতা নয়। সেটা ১৯৯৬। যদিও তার প্রথম পুরষ্কার পাওয়া রাজ্য সরকারের হাত থেকে, ১৯৯৯-এ। তারপর টানা ৬ বার সেরা ধোকরা শিল্পীর পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন। গীতার কথায়, "ডোকরা পটের গায়ে একটা ছোট্ট নৌকার ওপর ছবিতে সৃষ্টি করেছিলাম বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনী। সেটাই এনে দিয়েছিল সেরার সম্মান।" রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছিলেন ২০০৩-এ লক্ষীর গল্প লিখে। ধোকরার পটে। কিন্তু টাকা বেশি পাননি। মাত্র ১০ হাজার!
তবু পরবর্তীকালে ব্যাঙ্ক লোনের পরিমাণ সরকার বাড়িয়েছে। আড়াই লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ টাকা করে দিয়েছে। এখন গীতা কর্মকারের নেতৃত্বে বাঁকুড়ার বিঘনা গ্রামে একাধিক ধোকরা শিল্পী। বংশ পরম্পরায় ধোকরা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারা।
আর এর মধ্যে গীতা কর্মকারের আলাদা প্রাপ্তি, ছেলে তাপস কর্মকারও সম্পূর্ণ এক শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। গীতার কথায়, "এবছর রাজ্য সরকারের সেরা ধোকরা শিল্পীর সম্মান পেয়েছে ছেলে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে আমার কাছে!"
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment. Feel free to contact for any queries, suggestions or any proposal.